Home আন্তর্জাতিক সাংবাদিক থেকে প্রধানমন্ত্রী

সাংবাদিক থেকে প্রধানমন্ত্রী

665
0
SHARE

প্রায় দুই দশকের সাংবাদিকতা আর রাজনৈতিক জীবনের নানা উত্থান-পতন পেরিয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন বরিস জনসন।

ঘনিষ্ঠ মিত্রদের ‘বিশ্বাসঘাতকতায়’ কয়েক বছর আগেও যার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার হুমকির মুখে পড়েছিল, যার উল্টোপাল্টা মন্তব্য অনেকবারই কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃত্বকে বিব্রত করেছে অবশেষে সেই জনসনই যাচ্ছেন ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটে।
মঙ্গলবার পার্টি তাদের নতুন প্রধান হিসেবে ৫৬ বছর বয়সী সাবেক এ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নাম ঘোষণা করে। চূড়ান্ত পর্যায়ে জনসনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেরেমি হান্টের সঙ্গে। তবে দলের নিবন্ধিত কর্মী-সমর্থকরা শেষ পর্যন্ত লন্ডনের সাবেক মেয়রকেই বেছে নিয়েছেন।

জন্ম পরিচয়

পিতৃকূলের দিক থেকে জনসনের রয়েছে একইসঙ্গে ব্রিটিশ ও তুর্কি উত্তরাধিকার। তার প্রো-পিতামহ আলি কামাল ছিলেন অটোম্যান সাম্রাজ্যের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। সুলতানের গ্র্যান্ড ভিজার (প্রধানমন্ত্রী) দামাত ফরিদ পাশার মন্ত্রিসভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সাবেক কনজারভেটিভ সাংসদ স্ট্যানলি জনসন ও তার প্রথম স্ত্রী চিত্রকর শার্লট ফসেটের চার সন্তানের একজন বরিস। জন্ম ১৯৬৪ সালের জুনে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে।

সাংবাদিকতা

ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর জনসনের সাংবাদিক জীবন শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে টাইমসের প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেন। ডেইলি টেলিগ্রাফে জনসন ইউরোপবিষয়ক সংবাদদাতা ছিলেন পাঁচ বছর। পরে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৪ সাল থেকেই জনসন ম্যাগাজিন ‘দ্য স্পেকটেটরে’ রাজনৈতিক কলাম লেখা শুরু করেন। ১৯৯৯ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত তিনি ম্যাগাজিনটির সম্পাদক ছিলেন। ১৯৯৮ সাল থেকে জনসনকে বিবিসির ‘হ্যাভ আই গট নিউজ ফর ইউ’সহ টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা যেত। উল্টোপাল্টা মন্তব্যের কারণে তিনি টকশো’র জনপ্রিয় মুখে পরিণত হন।

রাজনীতি

১৯৯৭ সালে টেলিগ্রাফে থাকার সময়ই ক্লয়েড সাউথ এলাকা থেকে কনজারভেটিভ প্রার্থী হিসেবে হাউস অব কমন্স নির্বাচনে লেবার পার্টির মার্টিন জোন্সের কাছে পরাজিত হন। ২০০১ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে হেনলি অন টেমস আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হন। এক সাংবাদিকের সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জনে ছায়া শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়া হয়। ২০০৫-এর নির্বাচনে ফের জয়ী হন তিনি। দুই বছর লন্ডনের মেয়র নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে অপরাধ দূর ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাজিমাত করেন জনসন। ২০১২ সালের নির্বাচনে ফের জিতে দলকে দিয়েছিলেন স্বস্তি। ২০০৭ সালের মেয়র নির্বাচনে দাঁড়িয়ে সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে দেয়ার আট বছর পর ২০১৫ সালে পশ্চিম লন্ডনের আসনে জয়ী হয়ে ফের পার্লামেন্টে ঢোকেন জনসন।

পারিবারিক জীবন

দুই ছেলে ও দুই মেয়ের বাবা জনসন প্রথমে ১৯৮৭ সালে অ্যালেগ্রা মস্টিন ওয়েনকে বিয়ে করলেও তাদের সংসার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯৩ সালে জনসন আইনজীবী মেরিনা-হুইলারের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। জনসনের চার সন্তানের মা-ই মেরিনা। দুই যুগ পর গত বছর এ দম্পতি বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন।

লেখালেখি

প্রবন্ধ সংকলন ‘লেন্ড মি ইউর ইয়ারস’ ছাড়াও জনসন উপন্যাস ‘সেভেন্টি টু ভার্জিনস’ ও রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে ‘দ্য ড্রিম অব রোম’ লিখেছেন। ২০১৪ সালে ঝুলিতে যুক্ত করেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে নিয়ে লেখা ‘দ্য চার্চিল ফ্যাক্টর : হাউ ওয়ান ম্যান মেইড হিস্টরি’ বইটিও।

ব্রেক্সিট জট খুলতে বরিসের তিন চাবি

ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বরিস জনসনের প্রথম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ব্রেক্সিট। অর্থাৎ ব্রিটেনকে সহিহ-সালামতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাইরে নিয়ে আসা। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রিত্বের লড়াইয়ের শুরু থেকেই বিভিন্ন নিদান বা কৌশলের কথা বলে আসছেন তিনি।

তবে ইউনিয়নের অন্য ২৭ সদস্য রাষ্ট্রগুলো গলায় বেশ ঝাঁজ নিয়েই বলছে, ইউনিয়ন থেকে বের হওয়ার লক্ষ্যে ২০১৬ সালে গণভোটের পর থেকে গত তিন বছরে সম্ভাব্য প্রায় সব অপশনই চেষ্টা করে দেখেছে তারা।

শেষ পর্যন্ত বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে’র সঙ্গে একটি চুক্তিতে পৌঁছতে সমর্থ হয় তারা। কিন্তু বহু কষ্টার্জিত সেই চুক্তি বারবার প্রত্যাখ্যান করেছেন তার দলের এমপিরাই। ফলে দুই-দুইবার পেছাতে হয়েছে বিচ্ছেদ তারিখ। এ নিয়ে ক্রমেই একটি জটিল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সেই জট ছাড়াতে তিনটি চাবি নিয়ে আসছেন বরিস।

প্রথম চাবি : ব্রিটিশ পার্লামেন্টে তেরেসার ব্রেক্সিট চুক্তি একাধিকবার ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। আদর্শগতভাবেই পূর্বসূরির চুক্তির স্থলে নতুন চুক্তি আনতে চান বরিস। নতুন চুক্তি সময়সাপেক্ষ হলেও নিজের মতো করেই এগোতে চান তিনি। তেরেসার সঙ্গে চুক্তিতে পৌঁছতে সময় লেগেছিল প্রায় ১৭ মাস। প্রায় দেড় বছরের চেষ্টায় ও শ্রমে ৫৮৫ পৃষ্ঠার চুক্তির খসড়া প্রস্তুত হয়। ইইউ নেতারা বলে আসছেন, নতুন করে আর কোনো চুক্তি নিয়ে কথা বলবেন না তার।

দ্বিতীয় চাবি : প্রথম চাবিতে কাজ না হলে বিকল্প হিসেবে দ্বিতীয় চাবি বের করবেন বরিস। এক্ষেত্রে তেরেসার চুক্তি ‘সবচেয়ে ভালো অংশগুলো’ পার্লামেন্টে পাস করানোর চেষ্টা করবেন তিনি। ব্রিটেনে ইইউ নাগরিক অধিকার, নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক সহযোগিতা চুক্তির নবায়ন বা বৃদ্ধির মতো ইস্যুগুলো থাকবে এর মধ্যে। এর বাইরে ইইউ সদস্য দেশ আয়ারল্যান্ড ও ব্রিটেনের উত্তর আয়ারল্যান্ডের মধ্যকার ‘ব্যাকস্টপ’ ইস্যুটি এর বাইরে থাকবে। বিচ্ছেদ বিল বাবদ ইইউকে ৩৯ বিলিয়ন ডলারের সরবরাহ শুরু করা হবে কিনা সেটা নিয়েও ‘গঠনমূলক আলোচনা’ করতে চান বরিস।

তৃতীয় চাবি : চুক্তি ছাড়াই ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)

ছেড়ে বেরিয়ে যাবে ব্রিটেন। তিনি বলেছেন, যে করে হোক, ৩১ অক্টোবর ইইউ ছেড়ে বেরোতেই হবে ব্রিটেনকে।

এর মধ্যে লেবার পার্টির সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার

এবং গর্ডন ব্রাউন জানিয়েছেন, ইইউ থেকে বেরনোর জন্য চুক্তিহীন ব্রেক্সিট অত্যন্ত বিপজ্জনক। তারা মনে করেন, কঠিন পরিস্থিতি থেকে ব্রিটেন আরও ভয়ংকর জায়গায় পৌঁছবে।