Home আন্তর্জাতিক হজ্বের খুতবায় শান্তি ঐক্য সমৃদ্ধির বার্তা

হজ্বের খুতবায় শান্তি ঐক্য সমৃদ্ধির বার্তা

657
0
SHARE

পবিত্র হজ্বে¡র খুতবায় মুসলিম উম্মাহর শান্তি, ঐক্য ও সমৃদ্ধির ওপর জোর দিয়েছেন খতিব। দীর্ঘ লিখিত খুতবায় তিনি সঠিক ইসলামের পথে মুসলিমদের ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সমৃদ্ধি কামনা করে দোয়াও করেছেন। কুরআন ও হাদিসের বিভিন্ন উদ্ধৃতি উল্লেখ করে মুসলিম উম্মাহকে তাকওয়া অবলম্বনের আহ্বান জানানো হয়। কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা মতো জীবন গঠনের প্রতি তাগিদ দেয়া হয়। পবিত্র গ্রন্থ আল কুরআনকে জীবনের পাথেয় বানাতে বলেন খতিব। মুসলিম উম্মাহর মুক্তির উপায় উল্লেখ করে শায়খ মুহাম্মদ বিন হাসান হজ্বে¡র খুতবায় বলেন, পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালার রহমতের কথা বারবার বলা হয়েছে। আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরাই মুক্তির একমাত্র উপায়। এ ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই। উল্লেখ্য গতকাল অযুত কণ্ঠের লাবাবায়িক ধনীতে মুখরিত ছিল আরাফা ময়দান।
গতকাল শনিবার দুপুরে ঐতিহাসিক আরাফাতের ময়দানে মসজিদে নামিরায় এবার হজ্বের খুতবা দেন শাইখ ড. মুহাম্মদ বিন হাসান আল-শাইখ। তিনি সৌদি আরবের সর্বোচ্চ উলামা বোর্ডের সদস্য এবং খাদেমুল হারামাইন শরিফাইন হাদিস কমপ্লেক্সের প্রধান শাইখ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। হজ্বের দ্বিতীয় দিনে বিকালে সৌদি আরবে আরাফাতের ময়দানে হঠাৎ প্রচন্ড ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়। এসময় আরাফাতের ময়দানে আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটোছুটি করতে দেখা যায় হাজিদের।
১৯৮১ সাল থেকে আরাফার ময়দানের খতিবের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন দৃষ্টিহীন ইমাম শাইখ আবদুল আজিজ। দীর্ঘ ৩৫ বছর পর তিনি বার্ধক্যজনিত কারণে অবসরে গিয়েছেন। ২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো হজ্বের খুতবা দেন শাইখ আবদুর রহমান আস-সুদাইস। ২০১৮ সালে আরাফার ময়দানে হজ্বের খুতবা দেন বিচারপতি শাইখ হুসাইন ইবনে আবদুল আজিজ ইবনে হাসান।
এবারের হজ্বের খুতবায় হারামাইন শরিফাইনের মর্যাদা ও সম্মান রক্ষার আহ্বান জানিয়ে খতিব সৌদি রাজপরিবারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। সৌদি বাদশা সালমান বিন আবদুল আজিজসহ রাজপরিবারের সদস্যদের জন্য দোয়া করেছেন। খুতবায় মুহাম্মদ বিন সালমানের কথাও উল্লেখ করেন। তার দীর্ঘ হায়াত ও কল্যাণের জন্যও দোয়া করা হয়।
খুতবার শুরুতে তিনি আল্লাহতায়ালার প্রশংসা, রাসূলুল্লাহর (সা.) ওপর দরুদ পাঠ করেন। উপস্থিত হাজীদের সুস্থতা কামনা করেন। তাদের জন্য দোয়া করেন। খুতবায় রাসূলের (সা.) একটি হাদিস পড়েন, যার মূলকথা হলো- কোনো মুসলমানের যদি সক্ষমতা অর্জন হয়, তাহলে জীবনে একবার হলেও তাকে অবশ্যই হজ্ব¡ করতে হবে।
শায়খ মুহাম্মদ বিন হাসান বলেন, তাওহিদ ও খতমে নবুওয়তের সাক্ষী ইসলামের মৌলিক রোকন। এছাড়াও নামায ও জাকাত ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধান। জাকাতের মাধ্যমে গরিব অসহায়দের ব্যাপক কল্যাণ সাধিত হয়।
হজ্বের খুতবায় আরও বলা হয়, আল্লাহ তায়ালার হুকুম কখনও পরিবর্তন হয় না। আল্লাহ তায়ালা মানুষ এবং জীন জাতিকে তার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। এ জন্য তাওহিদ ও আল্লাহর একত্ববাদের বিষয়টি আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে।
মুসলিম উম্মাহর মুক্তির উপায় উল্লেখ করে শায়খ মুহাম্মদ বিন হাসান হজ্বের খুতবায় বলেন, পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালার রহমতের কথা বারবার বলা হয়েছে। আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরাই মুক্তির একমাত্র উপায়। এ ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই।
হজ্বের খুতবায় মুসলমানদের আমল পরিশুদ্ধ করার প্রতি বিশেষ জোর দেয়া হয়। পারস্পরিক আচরণ, লেনদেন পরিশুদ্ধ করার তাগিদ দেয়া হয়। আমলের ত্রুটির কারণে মুসলিমরা দুর্যোগের শিকার হবে এমন সতর্কতাও দেয়া হয়।
কুরআন ও হাদিসের বিভিন্ন উদ্ধৃতি উল্লেখ করে মুসলিম উম্মাহকে তাকওয়া অবলম্বনের আহ্বান জানানো হয়। কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা মতো জীবন গঠনের প্রতি তাগিদ দেয়া হয়। পবিত্র গ্রন্থ আল কুরআনকে জীবনের পাথেয় বানাতে বলেন খতিব।
সৃষ্টির প্রতি দয়া ও সহনশীল হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। সৃষ্টির প্রতি দয়ার্দ্র হলে আল্লাহ তার প্রতি দয়াশীল হবে বলে হাদিসের বাণী উদ্ধৃত করেন। ধৈর্য ধারণের কথা বলা হয়। এক মুমিন আরেক মুমিনের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার তাগিদ দিয়ে বলা হয়, এর দ্বারা আল্লাহর রহমত অর্জিত হবে।
তিনি বলেন, রসুলগণ মানুষকে সত্যপথ দেখিয়েছেন এবং আল্লাহর একত্মবাদের কথা বলেছেন। তিনি বলেন, আল্লাহই সব কিছুর স্রষ্টা। তিনি বলেন, মহানবী (সঃ) যা বলেছেন তা আল্লাহর পক্ষ থেকে বলেছেন। তিনি মহানবীর (সঃ) সাহাবিদের মতো ঈমান আনয়নসহ মানুষকে আল্লহর প্রতি, নবী-রসুলদের প্রতি, কিতাবসমূহের প্রতি, ফেরেস্তাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে বলেন। নামায ও যাকাত আদায় রোজা ও হজ্ব¡ পালনের কথা বলেন। কবুল হজ্বের প্রতিদান জান্নাত বলে উল্লেখ করেন তিনি। এছাড়া দশম হিজ্বরিতে নহানবী (সঃ) হজ্ব পালন করেন, শরিয়ত মতো চলা, সুদ থেকে বিরত থাকা, আল্লাহর নেয়ামত স্মরণ করার কথাও বলেন।
খুতবায় ইমাম বলেন, রসুল ছিলেন উত্তম চরিত্রের অধিকারী। তিনি মোমেন ও কাফেরদের পার্থক্যের কথা, কুরআন যে গোটা বিশ্বের জন্য রহমত সে কথা, ন্যায় বিচার, উত্তম চরিত্রের কথা, মহানবী(সঃ) যে পিতা-মাতার সাথে ভালো ব্যবহার করতেন সে কথা বলেন। তিনি শিরক না করা ও না জেনে কথা না বলার জন্য বলেন। পরস্পরের মধ্যে সুন্দর সম্পর্ক বজায় রাখা ও দরদী হবার জন্য তাগিদ দেন তিনি।
তিনি বলেন, মহানবী (সঃ) আল্লাহর পক্ষ থেকে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করেছেন। খুতবায় তিনি অন্যের মালামাল হেফাজত ও সীমা লক্ষঘন না করার জন্য বলেন। জুলম, অন্যের সম্পদ গ্রাস, প্রতিশ্রতি রক্ষা আল্লাহর আনুগত্য, শৃংখলা বিধান, সন্ত্রাসী কাজ থেকে বিরত থাকতে বলেন। নারী ও পুরুষদের অধিকার নিশ্চিত করা ও এ বিষয়ে শরিয়তের কঠিন তাগিদের উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, কাবা মানুষের জন্য শান্তি ও নিরাপদ, মক্কা ও মদিনার বিরুদ্ধবাদীদের আল্লাহ শাস্তি দিবেন এবং তা রক্ষা করার দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ পাকের। মসজিদুর আকসার দায়িত্ব আবারও মুসলমানদের হবে। তিনি আরাফার দিবসের গুরুত্বেও কথা বলেন। এ দিন সবচেয়ে বেশী মানুষকে আল্লাহপাক ক্ষমা করবেন বলে উল্লেখ করেন।
খুতবার শেষ দিকে হজ্বের আহকাম জানিয়ে দেন খতিব। মুসলমানদের ঐক্য ও সমৃদ্ধি কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করেন।
খুতবা সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ও বিশ্বের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি টেলিভিশন সরাসরি সম্প্রচার করছে। অনেক হজ্ব এজেন্সি নিজ উদ্যোগে আরাফার ময়দানে উপস্থিত হাজীদেরকে খুতবার অনুবাদ শোনানোর ব্যবস্থা নিয়েছেন।
আরাফার ময়দানে উপস্থিত সফেদ-শুভ্র কাপড়ের ইহরাম পরিহিত হাজীদের সামনে দেওয়া হজ্বের খুতবা বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। এ খুতবা যেমন সমবেত হাজীরা শোনেন, তেমনি শোনেন বিশ্ববাসী।
খুতবার মধ্য দিয়ে শেষ হলো হজ্বের মূল আনুষ্ঠানিকতা। খুতবার পরপরই মসজিদে নামিরায় এক আজানে জোহর এবং আসরের নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। সূর্যাস্ত পর্যন্ত হাজিরা আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করেন। সূর্যাস্তের পর তারা মাগরিবের নামাজ না পড়ে রওয়ানা করেন মুজদালিফার উদ্দেশে। সেখানে একসঙ্গে মাগরিব ও ইশার নামাজ আদায় করে রাত যাপন করবেন।
আজ ফজরের পর হাজিরা রওয়ানা করবেন মিনার উদ্দেশ্যে। সেখানে তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে পশু কুরবানি করবেন। শয়তানকে পাথর মারবেন। এছাড়া বায়তুল্লায় গিয়ে তওয়াফ করবেন।
আরব নিউজ জানিয়েছে, হজ্জের সময় আরাফাতর ময়দানে মুষুলধারে বৃষ্টি হয়েছে। এ সময় অনেকে বিভিন্ন স্থানে আশ্রয়ের জন্য ছুটে যায়। এক হাজী জানান, আমি খুবই আনন্দিত, আমার হজ্জের সময় আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমতে সিক্ত হয়েছি।
সৌদি সংবাদ মাধ্যম খালিজ টাইমস জানায়, জোহরের আজানের পর হজ্বের খুতবা পড়েন শাইখ ড. মুহাম্মদ বিন হাসান আল শাইখ। জোহর-আসর একসঙ্গে আদায় করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করার কথা ছিল হাজিদের। দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত অত্যন্ত গরম আর আর্দ্র আবহাওয়া ছিল এই এলাকায়। হঠাৎ করেই বজ্রপাত ও বিদ্যুৎ চমকের মধ্য দিয়ে প্রবল ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়। এর আগে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে গতকাল সারা বিশ্ব থেকে আসা লাখ লাখ মুসলমান জড়ো হয়।
সৌদি গেজেট জানিয়েছে, শুক্রবার এক সাংবাদিক সম্মেলনে কেন্দ্রীয় হজ্জ কমিটির চেয়ারম্যান ও মক্কা’র আমীর প্রিন্স খালেদ আল ফয়সাল জানান, এ বছর ২০,৯১,৪৭১ জন হজ্জে অংশ গ্রহন করেন। এর মধ্যে ২,০০,৩৬০ জন সৌদি আরব থেকে বাকী ১৮,৫৫,৪০৭ জন বিশে^র বিভিন্ন দেশ থেকে হজ্বে অংশগ্রহণ করেন।