Home এইমাত্র ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি ১৭০৬ তিনজনের মৃত্যু

২৪ ঘণ্টায় ভর্তি ১৭০৬ তিনজনের মৃত্যু

572
0
SHARE

দেশের জেলা-উপাজেলা পর্যায়ে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। এমন কোনো এলাকা নেই যেখানে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী নেই। অনুকূল আবহাওয়া ও পর্যাপ্ত প্রজনন ক্ষেত্রের কারণে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার বিস্তার বাড়ছে। নানা পদক্ষেপ নিয়েও এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না।

অথচ এটি নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে ডেঙ্গু নির্মূল করা অসম্ভব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। দেশে এ পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৫৩ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। রোববার তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের বাড়ি সিরাজগঞ্জ, জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ ও নোয়াখালী।

বিশেষজ্ঞদের মতে, চলতি মৌসুমে ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পেতে এডিস মশা নির্মূলের পাশাপাশি ব্যক্তি সচেতনতা বাড়াতে হবে। মশা ও মানুষের মধ্যে বিভেদ তৈরি করতে হবে। যাতে মশা সহজে মানুষের সংস্পর্শে আসতে ও কামড়াতে না পারে। একই সঙ্গে মশার সব ধরনের প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস করতে হবে। এ বছর ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনার পর ভবিষ্যতেও এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে সচেতনতা সপ্তাহ বা দিবস পালন করা যেতে পারে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, ১ জানুয়ারি থেকে ১৮ আগস্ট পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ৫৩ হাজার ১৮২ জন ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ছাড়পত্র নিয়ে বাসায় ফিরেছেন ৪৫ হাজার ৯৭৪ জন। বিভিন্ন স্থানে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে সাত হাজার ১৬৮ জন ভর্তি রয়েছেন। ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ১৭০৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার জানান, ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা শহরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৭৩৪ জন এবং ঢাকার বাইরে ৯৭২ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে। ঢাকার ৪১টি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল থেকে এ তথ্য জানা গেছে। তবে প্রকৃত আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি।

জানা গেছে, ডেঙ্গু খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের (সিডিসি) তথ্যমতে, বিশ্বের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ ডেঙ্গুপ্রবণ এলাকায় বসবাস করে। এশিয়া, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল, আমেরিকা, আফ্রিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের প্রায় ১০০টি দেশে এ রোগ ছড়িয়ে পড়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে প্রতি বছর পাঁচ থেকে ১০ কোটি মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে পাঁচ লাখ মানুষ হেমোরেজিক জ্বরে ভোগে আর কমপক্ষে ২২ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে। এর মধ্যে বড় একটি অংশ শিশু।

এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনা বলেন, আমাদের দেশ থেকে বা পৃথিবী থেকে এডিস মশা চিরতরে নির্মূল করা সম্ভব নয়। তাই ডেঙ্গুজ্বর নিয়ন্ত্রণ করতে হলে অবশ্যই নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করতে হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ডেঙ্গু সংক্রমণ ঠেকাতে বিজ্ঞানীরা বহু বছর ধরে ওলবাকিয়া ব্যাক্টেরিয়া নিয়ে কাজ করছেন। এ ব্যাক্টেরিয়া নিরাপদ। প্রকৃতিতে অন্য পোকা-মাকড়ের মধ্যে এটি পাওয়া গেলেও এডিস ইজিপ্টি মশায় এটি পাওয়া যায় না।

বিজ্ঞানীদের ধারণা, এ ব্যাক্টেরিয়া এডিস মশার মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে পারলে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। এটি মূলত দু’ভাবে মশার দেহে কাজ করে- ভাইরাসের বিরুদ্ধে মশার শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং ভাইরাসের বৃদ্ধি ব্যাহত করে। বিজ্ঞানীদের মতে, প্রক্রিয়াটি প্রাকৃতিক, সাশ্রয়ী ও টেকসই। ‘ওয়ার্ল্ড মাস্কিউটো প্রোগ্রাম’ প্রকল্প অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের ১২টি দেশে এ পদ্ধতি প্রয়োগ করছে।

এ ছাড়া ‘স্টেরাইল ইনসেক্ট টেকনিক (এসআইটি)’ বা মশা বন্ধ্যাকরণ পদ্ধতি প্রয়োগ করেও কোনো কোনো দেশে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় গামা রশ্মি ব্যবহার করে এডিস পুরুষ মশাকে বন্ধ্যাকরণ করা হয়। এরপর এ মশা স্বাভাবিক মশার তুলনায় ১০ গুণ বেশি ছেড়ে স্ত্রী মশার সঙ্গে প্রজনন ঘটানো হয়। এরপর স্ত্রী এডিস মশা ডিম পাড়লে সেই ডিম থেকে আর লার্ভা জন্মায় না।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিশিষ্ট কীটতত্ত্ববিদ ড. মঞ্জুর চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ওলবাকিয়া এবং এসআইটি পদ্ধতি দুটিই ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ। বর্তমানে আমাদের দেশে ডেঙ্গুর যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে সে অবস্থা এসব পদ্ধতি প্রয়োগ সময়োপযোগী নয়।

তিনি বলেন, এ মুহূর্তে উন্নতমানের ফগিং মেশিন ও কার্যকর ওষুধ ব্যবহার করে বিস্তীর্ণ এলাকায় ফগিং করে প্রাপ্তবয়স্ক এডিস মশা মারতে হবে। পাশাপাশি প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস করতে হবে। এ ছাড়া মানুষ ও মশার মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করতে হবে। যাতে মশা মানুষকে কামড়াতে না পারে। এ ক্ষেত্রে ফুল হাতা জামা-পায়জামা পরা, মশারি ব্যবহার করা, বাড়িতে অ্যারোসল স্প্রে করা, গায়ে মশক নিরোধ স্প্রে বা ক্রিম ব্যবহার করতে হবে।

জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ যুগান্তরকে বলেন, সিঙ্গাপুরের মতো দেশেও এ বছর ১০ হাজারের বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। এ কারণে শুধু কর্তৃপক্ষই নয়, নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতন হতে হবে। এডিস মশার হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে হবে। তিনি বলেন, এভাবে চেষ্টা করলে অল্প সময়ে হয়তো এডিস মশার প্রকোপ সহনীয় পর্যায়ে আনা সম্ভব হবে।

‘ওলবাকিয়া’ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ পদ্ধতি ব্যবহার করতে হলে ১০ হাজার মানুষ বসবাস করে এমন স্থানে পাইলট করে সফল হলে তারপর বিস্তীর্ণ এলাকায় এটা ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে বর্তমান সময়ে এটা তেমন কার্যকর নয়। এ ছাড়া এসআইটি পদ্ধতিকে ব্যয়বহুল হিসেবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সরাসরি মশক নিধন ও উৎস নির্মূল কর্মসূচির পাশাপাশি ব্যক্তিগত সচেতনতাই সবচেয়ে কার্যকর।

এ বছর ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসার পর এই বিষয়ে সচেতনতা অব্যাহত রাখতে হবে। আগামীতে ডেঙ্গুবিষয়ক সচেতনতা দিবস বা সপ্তাহ পালন করা যায় কি না, সেটিও ভেবে দেখা হবে বলেও জানান তিনি।

তিনজনের মৃত্যু : সিরাজগঞ্জ ও জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে দু’জন এবং ঢাকায় নোয়াখালীর একজনের মৃত্যু হয়েছে। সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে কামারখন্দ উপজেলার কলেজছাত্র মেহেদী হাসান মীম তালুকদারের (১৬) মৃত্যু হয়েছে।

শনিবার রাত ৮টার দিকে সিরাজগঞ্জ বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। সরকারি হাজী কোরপ আলী মেমোরিয়াল কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র মীম উপজেলার হালুয়াকান্দি গ্রামের আমিনুল ইসলাম তালুকদারের ছেলে।

হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মো. ফরিদুল ইসলাম জানান, ১৪ আগস্ট জ্বর নিয়ে হাসপাতালে মীম ভর্তি হয়। কয়েকদিনের চিকিৎসায় বেশ সুস্থও হয়ে ওঠে। শনিবার সকালে সে হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে রাত ৮টার দিকে তার মৃত্যু হয়।

জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, চুনিয়াপাড়া গ্রামের মাজেদুল ইসলামের স্ত্রী বৃষ্টি বেগম (২০) ঢাকায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১১ আগস্ট দেওয়ানগঞ্জ হাসপাতালে ভর্তি হয়। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তবে ঈদ উপলক্ষে দেওয়ানগঞ্জ এলে রোববার তার মৃত্যু হয়।

নোয়াখালী প্রতিনিধি জানান, ঢাকা-নোয়াখালীর মধ্যে চলাচলকারী হিমাচল পরিবহনের সুপারভাইজার নাজিম উদ্দিন ডেঙ্গুতে মারা গেছেন। হিমাচল বাস কাউন্টার সূত্র জানায়, বেগমগঞ্জ উপজেলার চৌমুহনী পৌরসভার গনিপুর গ্রামের বাড়িতে নাজিম বুধবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন।

শনিবার সকালে তাকে ঢাকার ইউনিভার্সেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রোববার ভোরে তিনি মারা যান। তার মৃত্যুতে চৌমুহনী পৌর এলাকায় ডেঙ্গু আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বৈঠক : স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেকের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও চিকিৎসা মনিটরিং সেলের’ সদস্যরা। ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয় ও জনসচেতনতা সৃষ্টিতে প্রচার বিষয়ে আলোচনা করা হয়।

সভায় ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়, সিটি কর্পোরেশন ও এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। পাশাপাশি এডিস মশার বিস্তার কমাতে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রচার বৃদ্ধি করার বিষয়েও আলোচনা হয়।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের সভাপতিত্বে সভায় আওয়ামী লীগ ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও চিকিৎসা মনিটরিং সেলের আহ্বায়ক ও সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যাবিষয়ক সম্পাদক ডা. রোকেয়া সুলতানা, বিএসএমএমইউর উপাচার্য ও কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া, স্বাচিপ মহাসচিব ডা. এমএ আজিজ, বিপিএসপিএর মহাসচিব ডা. জামাল উদ্দিন চৌধুরী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।