Home আইন আদালত মিডিয়ার সঙ্গে কথা না বলার শর্তে মিন্নির জামিন

মিডিয়ার সঙ্গে কথা না বলার শর্তে মিন্নির জামিন

465
0
SHARE

বরগুনার চাঞ্চল্যকর রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় তার স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে দুই শর্তে স্থায়ী জামিন দিয়েছে হাই কোর্ট। জামিন প্রশ্নে এক সপ্তাহ আগে জারি করা রুল যথাযথ ঘোষণা করে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চ গতকাল এ রায় দেয়। জামিনের শর্তে হাই কোর্ট বলেছে, মিন্নি তার বাবার জিম্মায় থাকবেন এবং গণমাধ্যমের সামনে কোনো কথা বলতে পারবেন না। এ রায়ে মর্মাহত উল্লেখ করে নিয়মিত লিভ টু আপিল দাখিলের কথা জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী।

এদিকে রায়ের পর্যবেক্ষণে বরগুনার পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেনের বিষয়ে হাই কোর্ট বলেছে, মিন্নি দোষ স্বীকার করেছেন মর্মে যে বক্তব্য তিনি দিয়েছেন, তা শুধু অযাচিত, অনাকাক্সিক্ষত নয়, বরং সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের পরিপন্থী। তদন্ত চলমান থাকায় এ বিষয়ে আদালত কোনো সিদ্ধান্ত না দিলেও সময়মতো এসপির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আইজিপিকে বলেছে আদালত। এ ছাড়া তদন্ত পর্যায়ে পুলিশের ব্রিফিং নিয়ে নীতিমালা করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইজিপিকে নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট। গতকাল মিন্নির পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না ও মাক্কিয়া ফাতেমা ইসলাম। রাষ্ট্রপক্ষে জামিন আবেদনের বিরোধিতা করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারোয়ার হোসেন বাপ্পী। শুনানির সময় বরগুনার আদালতে মিন্নির আইনজীবী ও জেলা বারের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাহাবুবুল বারী আসলামও হাই কোর্টে উপস্থিত ছিলেন।
মেয়ের জামিন হওয়ায় আদালতে উপস্থিত মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি খুব খুশি যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দুষ্কৃতকারীরা যেগুলো করছে, এগুলো সব জনসমক্ষে প্রচার পেয়েছে।’ মিন্নির আইনজীবী জেড আই খান পান্না রায়ের পর সাংবাদিকদের বলেন, ‘মিন্নির জামিন মঞ্জুর হয়েছে। তবে তার প্রতি একটা নির্দেশনা আছে। তিনি মিডিয়ার সামনে কথা বলতে পারবেন না।’ অন্যদিকে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সারোয়ার হোসেন বাপ্পী বলেন, ‘এ রায়ে আমরা মর্মাহত। রাষ্ট্রপক্ষ এ রায়ের বিরুদ্ধে নিয়মিত লিভ টু আপিল করবে।’ ২০ আগস্ট এক সপ্তাহের রুল জারি করে মিন্নিকে কেন জামিন দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়েছিল হাই কোর্ট। ওই দিন একই সঙ্গে ২৮ আগস্ট মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে সিডি (মামলার যাবতীয় নথি) নিয়ে হাই কোর্টে হাজির হতে বলে আদালত। সে আদেশ অনুসারে বুধবার তদন্ত কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির কেস ডকেট নিয়ে আদালতে হাজির হন। পরে রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে রায়ের জন্য বৃহস্পতিবার দিন ঠিক করে হাই কোর্ট।

জামিনে হাই কোর্টের যেসব যুক্তি : মিন্নিকে জামিন দেওয়ার কারণ হিসেবে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম বলেন, ‘এজাহারে আসামির নাম উল্লেখ না থাকা, গ্রেফতারের আগে দীর্ঘ সময় মিন্নিকে পুলিশ লাইনসে আটক রাখা এবং গ্রেফতারের প্রক্রিয়া, আদালতে হাজির করে রিমান্ড শুনানির সময় তার আইনজীবী নিয়োগের সুযোগ না পাওয়া, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক লিপিবদ্ধ করার আগেই আসামির দোষ স্বীকার সম্পর্কিত জেলা পুলিশ সুপারের বক্তব্য, তদন্ত কর্মকর্তার মতে মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে, সুতরাং আসামি কর্তৃক তদন্ত প্রভাবিত করার কোনো সুযোগ না থাকা, সর্বোপরি ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৭ ধারার ব্যতিক্রম, অর্থাৎ আসামি একজন নারী- এ বিষয়গুলো বিবেচনা করে আমরা তাকে জামিন দেওয়া ন্যায়সংগত মনে করছি এবং জারি করা রুলটি আমরা যথাযথ ঘোষণা করলাম। তিনি তার বাবার জিম্মায় থাকবেন এবং মিডিয়ার সামনে কোনো কথা বলতে পারবেন না।’

এসপির বক্তব্য সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের পরিপন্থী : মিন্নিকে গ্রেফতার এবং তার জবানবন্দি নিয়ে পুলিশের ভূমিকা জামিন শুনানিতে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। রায়ের পর্যবেক্ষণেও পুলিশ সুপারের আচরণ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছে আদালত। রায়ের পর্যবেক্ষণে হাই কোর্ট বলেছে, আসামি আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি রিমান্ডে থাকা অবস্থায় বরগুনা জেলার পুলিশ সুপার জনাব মারুফ হোসেন গণমাধ্যমের সম্মুখীন হন। মিন্নি দোষ স্বীকার করেছেন মর্মে যে বক্তব্য তিনি দিয়েছেন, তা শুধু অযাচিত, অনাকাক্সিক্ষত নয়, বরং সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ তদন্তের পরিপন্থী। পরিস্থিতি ও বাস্তবতা যা-ই হোক না কেন, পুলিশ সুপারের মতো দায়িত্বশীল পদে থেকে মারুফ হোসেন যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা জনমনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে বলে মন্তব্য করেন বিচারক। রায়ের পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়েছে, (এসপি মারুফ হোসেন) একদিকে যেমন জনমনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছেন, তেমনি তিনি (এসপি) তার দায়িত্বশীলতা ও পেশাদারিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন, এটি দুঃখজনক এবং হতাশাজনক। উচ্চপর্যায়ের একজন পুলিশ কর্মকর্তার কাছ থেকে এ ধরনের কাজ প্রত্যাশিত বা কাম্য নয়। ভবিষ্যতে দায়িত্ব পালনে তিনি আরও সতর্কতা ও পেশাদারিত্বের পরিচয় দেবেন- আদালতের এটাই কাম্য। রায়ে হাই কোর্ট বলেছে, মামলাটির তদন্তকাজ যেহেতু এখনো চলছে, সে কারণে এ মুহূর্তে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে আদালত বিরত থাকছে। তবে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এসপির বিষয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক সময়মতো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।

গণমাধ্যমে বক্তব্য নিয়ে নীতিমালা তৈরির নির্দেশ : মামলার তদন্ত পর্যায়ে তদন্তের অগ্রগতি বা গ্রেফতারদের বিষয়ে গণমাধ্যমে কতটুকু বিষয় প্রচার বা প্রকাশ করা যাবে, সে বিষয়ে একটি নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রচারের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং পুলিশের মহাপরিদর্শককে নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট। রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, ইদানীং প্রায়শ লক্ষ করা যাচ্ছে যে, সংঘটিত আলোচিত ঘটনার তদন্তকালে পুলিশ, র‌্যাবসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক গ্রেফতারকৃত অভিযুক্তদের বিষয়ে এবং তদন্ত সম্পর্কে প্রেস ব্রিফিং করা হয়ে থাকে। গ্রেফতারকৃত সন্দেহভাজন বা অভিযুক্তদের কোনো নিয়মনীতি ছাড়াই গণমাধ্যমের সামনে হাজির করা হয়, যা অনেক প্রশ্নের উদ্রেক করে। যদিও বা এ বিষয়ে অত্র আদালতে একটি রায়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। হাই কোর্ট বলেছে, ‘অনেক পুলিশ কর্মকর্তাকে তদন্ত বিষয়ে অতি উৎসাহ নিয়ে বিভিন্ন বক্তব্য দিতে দেখা যায়। এ কথা আমাদের সবারই মনে রাখতে হবে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো অভিযুক্তের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-প্রমাণের মাধ্যমে অভিযোগ প্রমাণিত না হচ্ছে, ততক্ষণ বলা যাবে না সে অপরাধী বা অপরাধ করেছে।

তদন্ত বা বিচার পর্যায়ে এমনভাবে বক্তব্য উপস্থাপন করা উচিত নয়, যেন মনে হয় অভিযুক্ত ব্যক্তি অপরাধী। সে কারণে মামলার তদন্ত পর্যায়ে তদন্তের অগ্রগতি বা গ্রেফতারদের বিষয়ে গণমাধ্যমে কতটুকু বিষয় প্রচার বা প্রকাশ করা যাবে, সে বিষয়ে একটি নীতিমালা করা বাঞ্ছনীয়। এই নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রচারের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশের মহাপরিদর্শককে নির্দেশ প্রদান করা হলো।’