Home জাতীয় মশার ওষুধ ক্রয়ে ঢাকার দুই সিটির দুর্নীতির অনুসন্ধান

মশার ওষুধ ক্রয়ে ঢাকার দুই সিটির দুর্নীতির অনুসন্ধান

497
0
SHARE

দুই সিটির মেয়রের সঙ্গে কথা বলবে দুদক টিম, জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের * মশা নিধনের টাকায় ডিএসসিসির কর্মকর্তারা চার বছরে বহুবার বিদেশ ভ্রমণ করেন * আইসিডিডিআরবি ‘অকার্যকর’ ঘোষণার পরও মশার ওষুধ ব্যবহার করেছে দুই সিটি

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির বিরুদ্ধে মশক নিধনে অবহেলা ও ওষুধ ক্রয়ে দুর্নীতির ঘটনা অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক। সংস্থাটির এক পরিচালকের নেতৃত্বে গঠিত উচ্চ পর্যায়ের একটি দল কাজ শুরু করেছে। দুদকের হটলাইন ১০৬-এ আসা একটি অভিযোগের ভিত্তিতে প্রথম দফায় একটি এনফোর্সমেন্ট টিম অভিযান পরিচালনা করে।

তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে দুদক এবার সরাসরি মশক নিধনে ওষুধ ক্রয়ে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করেছে। দুই সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ‘অ্যানোফিলিস, এডিস, হেমাগোগাস মশার ওষুধ ক্রয় প্রক্রিয়ায় অনিয়মের অভিযোগ’ শিরোনামে অনুসন্ধানটি শুরু হয়।

টিমের প্রধান দুদক পরিচালক মুহাম্মদ ইউসুফ অনুসন্ধানের বিষয়ে বলেন, জনগণের সেবা সংক্রান্ত বিষয়ে সিটি কর্পোরেশনের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে আমরা কাজ শুরু করেছি। কী কী তথ্য সংগ্রহ করতে হবে, কাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে, সে বিষয়ে আমার টিমের সদস্যদের কিছু গাইডলাইন দিয়েছি।

টিমের অপর এক সদস্য জানান, অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে দুই সিটির মেয়রের সঙ্গে তারা কথা বলবেন। এ জন্য নোটিশ দেয়া হবে, না তাদের দফতরে গিয়ে কথা বলবেন, তা পরে ঠিক করা হবে। তিনি বলেন, দুই সিটির সংশ্লিষ্ট বিভাগের সব কর্মকর্তাকেই অভিযোগের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

মানহীন ওষুধ কেন আমদানি করা হল, কাদের কাছ থেকে এসব ওষুধ কেনা হয়েছে তাদেরও অনুসন্ধানের আওতায় আনা হবে।

এদিকে, দুদক থেকে এনফোর্সমেন্ট টিম গঠন করার বিষয়ে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মশক নিয়ন্ত্রণ বিভাগের কর্মকর্তারা অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেন না। এছাড়া তারা অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছেন- এমন অভিযোগ পাওয়ায় ওই টিম গঠন করা হয়।

টিমের সদস্য দুদকের সহকারী পরিচালক মামুনুর রশিদ চৌধুরী ও মাহবুব আলম প্রাথমিক তথ্য অনুসন্ধানের পর সম্প্রতি সুপারিশসহ কমিশনে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদনে মশা নিধন নিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয় তুলে ধরেন।

তাতে উল্লেখ করা হয়, মশক নিয়ন্ত্রণ বিভাগ সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করে অনিয়ম-দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছে। মশার লার্ভা ধ্বংস করার জন্য পর্যাপ্ত টিম গঠন করে প্রতিনিয়ত অভিযান পরিচালনার কথা থাকলেও এ ব্যাপারে তারা কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি।

মান পরীক্ষা করে ওষুধ ছিটানোর কথা থাকলেও মানহীন ওষুধ ছিটানোর কারণে মশার বংশবিস্তার রোধ করা সম্ভব হয়নি। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত ৪-৫ বছরে বিদেশ থেকে পর্যাপ্ত কিট ও ওষুধ আনার কথা থাকলেও তা না করে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা প্রশিক্ষণের নামে বিদেশ ভ্রমণ করেন।

এমতাবস্থায় এবার মশার প্রজনন মৌসুমে এডিস মশার উপদ্রব বেড়ে জনগণ মৃত্যুর মুখে পতিত হয়েছে।

গত ৬ আগস্ট দুদকের ওই কমিটির সদস্যরা লালবাগের ঢাকা মশক নিবারণী দফতর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ভাণ্ডার ও ক্রয় বিভাগ সরেজমিন পরিদর্শন করেন। ওইদিন মশক নিবারণী দফতরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আ.ন.ম ফজলুল হককে তার অফিসে পাওয়া যায়নি।

ওই অফিসের স্টোর কিপার গিয়াস উদ্দিনকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি জানান, দফতরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আ.ন.ম ফজলুল হক ছুটিতে থাকায় তার দায়িত্বে যিনি রয়েছেন তিনিও অফিসে আসেন না। উল্টো তার অফিসে গিয়ে ফাইলপত্র স্বাক্ষর করাতে হয়।

জানা যায়, ২৯ জুলাই পর্যন্ত ওই মশক নিবারণী দফতরে ৪০০ লিটার ওষুধ ছিল। ২ আগস্ট ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন উত্তর সিটি কর্পোরেশন থেকে ১০ হাজার লিটার মশার ওষুধ ধার নেয়। ৬ আগস্ট পর্যন্ত মশক নিবারণী দফতরে এসব ওষুধের ৩ হাজার ৪০০ লিটার অবশিষ্ট ছিল।

ওই দফতরের মজুদ মশা নিয়ন্ত্রণে ওষুধের ড্রাম খালি অবস্থায় পাওয়া যায় উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, এটি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, মশার অবাধ বিস্তারে সহায়ক। গোডাউনে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও মশার অবাধ বিচরণ রয়েছে। মূলত কর্মকতাদের অবহেলা, অনিয়ম আর দুর্নীতির কারণেই এমনটি হয়েছে।

মশক নিধনে কী ধরনের দুর্নীতি হয়েছে- মাঠ পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, মশার ওষুধ ক্রয়ে ধাপে ধাপে পার্সেন্টেজ (কমিশন) দিতে হয়।

কাজ নিতে ১৮ পার্সেন্ট, বিল নিতে ১২ পার্সেন্ট, ‘কিকবেক’ নিতে ১০ পার্সেন্ট, ভ্যাট-ট্যাক্স বাবদ ১৩ দশমিক ৫ পার্সেন্ট, ‘রিটেনশন মানি’ ১০ পার্সেন্ট। বাকি ৩৬ দশমিক ৫ পার্সেন্টে (টাকা) মশা মারার ওষুধ কেনা হয়।

তিনি আরও বলেন, কমিশন নেয়ার পর যে টাকা অবশিষ্ট থাকে তা দিয়ে কীভাবে মশার ওষুধ কেনা সম্ভব? এ টাকা দিয়ে ওষুধ তো নয়, ওষুধের গন্ধ পাওয়া যেতে পারে। তার এই কথার কিছুটা সত্যতা মেলে আইসিডিডিআরবির প্রতিবেদনে।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুই সিটির ব্যবহৃত ওষুধে মশা মরছে না। ওষুধের চেয়ে মশার প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি।

এদিকে দুদকের অনুসন্ধান প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দুদক মশার ওষুধ ক্রয় সংক্রান্ত কোনো তথ্য চেয়ে চিঠি দেয়নি। তদন্তের প্রয়োজনে দুদক কোনো সহায়তা চাইলে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবদুল হাইও দুদকের অনুসন্ধান সংক্রান্ত কোনো নোটিশ বা চিঠি পাননি বলে জানান। তবে যদি দুদক তদন্তের প্রয়োজনে এ ধরনের কোনো তথ্য চায় আমরা তা সরবরাহ করব।

চলতি মৌসুমে প্রথমে রাজধানীতে ডেঙ্গু ভাইরাস দেখা দেয়। পরে তা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। সরকারি হিসাবে, ডেঙ্গু আক্রান্ত মৃত্যুর সংখ্যা ৫৭ জন বলা হয়। তবে যুগান্তরের হিসাবে ১০ জন চিকিৎসক, একজন এডিশনাল আইজির স্ত্রী, কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাসহ অন্তত ১২৫ জন মারা গেছে।

যদিও বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা দেড় শতাধিক হতে পারে বলে ধারণা দেয়া হচ্ছে।

যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে, মশক নিধনের ওষুধ অকার্যকর জানার পরও তা পরিবর্তনের বিষয়ে গুরুত্ব দেয়নি ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। ২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনের বছর ছিল বলে অকার্যকর ওষুধের বিষয়টি চেপে যেতে চান দুই দফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

এবার মশা বাড়বে- স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের এমন সতর্কবার্তাও তারা কানে নেয়নি।

জানা যায়, সিন্ডিকেটের কবলে পড়ায় গতবারের কেনা মশার ওষুধ নিয়ে এবার সবচেয়ে বেশি কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। ঢাকাসহ সারা দেশে ডেঙ্গু রোগী ছড়িয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে দুই সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ওষুধ পরিবর্তনের কথা বলেন।

কিন্তু এরই মধ্যে সরবরাহকারীরা ওষুধ সরবরাহ করে তাদের পকেটভারি করে নিয়েছেন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে উত্তর সিটি কর্পোরেশন মশকনিধনে ১৪ কোটি টাকা ও দক্ষিণ সিটি ১৭ কোটি ৩৯ লাখ টাকার ওষুধ কিনেছে বলে ওই দফতর সূত্রে জানা যায়।

কিন্তু ওই টাকার ওষুধে ভেজাল ও কমিশন বাণিজ্যের কারণে জনগণের কাছে সেবা সেভাবে পৌঁছেনি। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) মশকনিধনের ওষুধ পরীক্ষা করে বলেছে, দুই সিটির সরবরাহকৃত ওষুধ ‘অকার্যকর’।

একই ওষুধ পরীক্ষা করে সরকারের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখাও (সিডিসি) বলেছে, ‘ওষুধ অকার্যকর’।

অনুসন্ধানে জানা যায়, দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন মশার ওষুধ ক্রয় করছে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে। ওই প্রতিষ্ঠান মশার ওষুধ আমদানি করে না। ওই প্রতিষ্ঠানের কোনো নিবন্ধনও নেই।

অন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নিয়ে তারা সরবরাহ করে বলে জানা যায়। তাদের নিবন্ধিত একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স বেলাল অ্যান্ড ব্রাদার্স লিমিটেড থেকে ওষুধ নিয়ে সিটি কর্পোরেশনের ঢাকেশ্বরীর মশক নিবারণী দফতরের গুদামে পৌঁছে দেয়।

ডিএসসিসিতে সরবরাহকৃত এক ওষুধ থেকে লভ্যাংশ পায় আমদানি প্রতিষ্ঠান ‘লিমিট অ্যাগ্রো’ এবং বেলাল অ্যান্ড ব্রাদার্স।

‘লিমিট অ্যাগ্রো’র ওষুধ দক্ষিণ সিটি কিনেছে প্রতি লিটার ৩৭৮ টাকা দামে। অথচ সেই প্রতিষ্ঠানই গত বছর অক্টোবরে উত্তর সিটির কাছে প্রতি লিটার ২১৭ টাকায় বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছিল।

উত্তর সিটির কাছে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১ লাখ লিটার মশা মারার ওষুধ বিক্রিতে লিমিট অ্যাগ্রো ও ‘নোকন’সহ তিনটি প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দেয়। সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে কাজ পায় লিমিট অ্যাগ্রো।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে লিমিট অ্যাগ্রো ৬৫ হাজার লিটার ওষুধ দেয়। অথচ এই প্রতিষ্ঠানের সরবরাহকৃত ওষুধ মাঠ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি।

পরবর্তীতে উত্তর সিটির কর্মকর্তারা লিমিটের কার্যাদেশ বাতিল করেন এবং এক বছরের জন্য কালো তালিকাভুক্ত করে। এই কালো তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেই দক্ষিণ সিটি মশক নিধনের ওষুধ নেয়। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কী ধরনের দুর্নীতি হয়েছে তা খতিয়ে দেখছে দুদক।

অন্যদিকে, উত্তর সিটি ‘নোকন’ নামের যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে গত অর্থবছরে ওষুধ নিয়েছে সেই প্রতিষ্ঠানটিও নিম্নমানের ওষুধ সরবরাহ করেছে বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়।

অভিযোগ উঠেছে, দুই সিটি কর্পোরেশন স্বচ্ছতার সঙ্গে ওষুধ কেনার ব্যাপারে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। এমনকি বিজ্ঞানীদের তথ্যের প্রতিও চরম অবহেলা প্রদর্শন করেছে। আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, ডেঙ্গু ভাইরাস বাহক এডিস মশা প্রচলিত কীটনাশক ব্যবহারে মরছে না।

ঢাকা শহরের এডিস মশা ওষুধপ্রতিরোধী। গত বছরের ২২ মে এই গবেষণার ফলাফল স্বাস্থ্য অধিদফতর ও দুই সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তাদের সামনে উপস্থাপন করেন আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানীরা। ওই গবেষণাতেই ওষুধের অকার্যকারিতা ধরা পড়ে।