গাজা উপত্যকায় ১৫ মাসের যুদ্ধের পর বহুল প্রতীক্ষিত যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ায় অঞ্চলজুড়ে উল্লাস শুরু হয়েছে। এই যুদ্ধ উপত্যকার বেশির ভাগ এলাকাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে।
যুদ্ধবিরতি স্থানীয় সময় রবিবার সকাল সোয়া ১১টায় কার্যকর হয়। এর আগে মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে হামাস তিনজন নারী জিম্মির একটি তালিকা ইসরায়েলের কাছে হস্তান্তর করে।
গাজার বাসিন্দা ওম সালাহ আলজাজিরাকে বলেন, ‘আমার আনন্দের কোনো সীমা নেই। যুদ্ধবিরতির ঘোষণা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি দ্রুত আমার জিনিসপত্র গোছাতে শুরু করি। কারণ আমি গাজা সিটিতে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। আমার সন্তানরাও পরিবার, আত্মীয়স্বজন ও ভূমি দেখতে যাওয়ার জন্য অত্যন্ত আনন্দিত।
এখানে আমরা সব সময় ভয়ে থাকি। কিন্তু আমাদের বাড়িতে ফিরে গেলে আমরা খুশি হবো। আমাদের জীবনে আনন্দ ফিরে আসবে।’
এক তরুণ ফিলিস্তিনি বলেন, ‘সবাই খুশি, বিশেষ করে শিশুরা।
আশা করি আগামী কয়েক দিনে ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করবে না।’ শিক্ষাজীবন সম্পূর্ণ করাই এখন তার একমাত্র লক্ষ্য জানিয়ে তিনি আলজাজিরাকে আরো বলেন, ‘এই গণহত্যার সময় বহু স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে।’
‘আমরা বেঁচে ফিরেছি’
গাজার স্বাস্থ্যকর্মী ও উদ্ধারকর্মীদেরও রাস্তায় উদযাপন করতে দেখা গেছে। অনলাইনে শেয়ার করা ও আলজাজিরার যাচাই করা ভিডিওতে দেখা গেছে, বেশ কয়েকটি সিভিল ডিফেন্স টিম গান গাইছে ও বিজয়ের প্রতীক দেখাচ্ছে।
দেইর এল-বালাহর আল-আকসা শহীদ হাসপাতালের বাইরে থেকে আলজাজিরার প্রতিবেদক হানি মাহমুদ জানিয়েছেন, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর থেকে চুক্তি লঙ্ঘনের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
তিনি বলেন, ‘আর কোনো বোমা নেই, আর কোনো যুদ্ধবিমান নেই, আর কোনো ড্রোন নেই। এখন রাস্তায় শুধু উদযাপনের গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে, বন্দুকের গুলি ও আতশবাজির শব্দ ঘন ঘন শোনা যাচ্ছে।’
যুদ্ধবিরতির কার্যকারিতার আগে রবিবার ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় আরো অন্তত ১৯ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং অগণিত মানুষ আহত হয়। ১৫ মাস ধরে চলা এই গণহত্যায় নিহতের সংখ্যা প্রায় ৪৭ হাজারে পৌঁছেছে। তবে ফিলিস্তিনি ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা আরো অনেক বেশি হতে পারে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলায় অন্তত এক হাজার ১৩৯ জন নিহত এবং প্রায় ২৫০ জন জিম্মি হয়।
আলজাজিরার প্রতিবেদক হিন্দ খুদারি খান ইউনিস থেকে জানান, দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর রাফার বাসিন্দারা ইসরায়েলের হামলায় সৃষ্ট ধ্বংসযজ্ঞকে ‘মারাত্মক’ বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘তারা তাদের নিজ এলাকার অবস্থানও বুঝতে পারছে না। তবু মানুষ খুব খুশি। সবাই হাসছে, সবাই স্লোগান দিচ্ছে। বেশির ভাগ ফিলিস্তিনি বলছেন, আমরা এই যুদ্ধ থেকে জীবিত ফিরে এসেছি।’
‘অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগ’
হাসপাতালের আঙিনা থেকে আলজাজিরার মাহমুদ জানান, সেখানে ফিলিস্তিনি পরিবারগুলো তাদের তাঁবু খুলে ফেলছে এবং যুদ্ধের সময় যেসব বাড়ি ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল, সেসব বাড়িতে ফিরে যেতে প্রস্তুত হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘এখানে আমরা যা দেখছি তা হলো, পরিবারগুলো উত্তেজনার সঙ্গে তাদের জিনিসপত্র জড়ো করছে। হাসপাতালের ফটক ছেড়ে যাওয়ার সময় তাদের মুখে উত্তেজনার চিহ্ন স্পষ্ট।’
খান ইউনিসে বসবাসরত বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি আনোয়ার জানান, তিনি রাফায় ফিরে যাওয়ার আশা করছেন। যদিও তার বাড়ি ধ্বংস হয়েছে বলে জানা গেছে। তিনি বলেন, ‘আমি সেখানে যাব এবং আমার পরিবারের আট সদস্যের সঙ্গে থাকার জন্য একটি তাঁবু খাটানোর জায়গা খুঁজব। আমাকে আমার শহরে ফিরে যেতে হবে। আমাকে সেখানে যেতে হবে, যেখানে আমি জন্মগ্রহণ করেছি।’
আনোয়ার জানান, এই কয়েক মাস যুদ্ধ ছিল ‘একটি দুঃস্বপ্নের মতো’। তিনি বলেন, ‘এটি আক্ষরিক অর্থেই একটি দুঃস্বপ্ন ছিল, যেন আমরা স্বপ্ন দেখছিলাম এবং তারপর আবার জেগে উঠেছি।’
এই ফিলিস্তিনি আরো জানান, তিনি ও তার পরিবার অস্থায়ী তাঁবুতে বাস করছিলেন, যেখানে যথেষ্ট খাবার বা পানি ছিল না এবং পণ্যের দাম ‘ব্যাপক বেশি’ ছিল।
গাজা সিটির বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি নারী নূর সাক্কা বলেন, তিনি এক ‘অভিভূতকারী আবেগের মিশ্রণ’ অনুভব করছেন। তিনি আলজাজিরাকে রাফা থেকে বলেন, ‘আমরা সম্পূর্ণরূপে স্বস্তি বোধ করতে পারিনি। শুধু এই ১৫ মাস কতটা চাপপূর্ণ ছিল সে কারণে নয়, বরং যুদ্ধবিরতির কারণেও। কারণ এটি একসঙ্গে ঘোষণা ও বাস্তবায়নের পরিবর্তে খণ্ডিতভাবে হচ্ছে।’
সাক্কা আরো বলেন, যুদ্ধবিরতির প্রথম পর্যায়ে গাজা সিটির অন্যা ফিলিস্তিনিদের মতো তিনি ও তার পরিবারের বাড়িতে ফিরতে না পারায় এই অবস্থার কারণে জনগণ ‘আরো বেশি মানসিক চাপে’ রয়েছে। ‘আমরা এমন অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগের মধ্যে বসবাস করছি যে এই স্বস্তিটাও সম্পূর্ণ নয়।’