Home জাতীয় তথ্য লুকিয়ে পলকের আইটি পার্ক, গচ্চা ১১৩৩ কোটি টাকা

তথ্য লুকিয়ে পলকের আইটি পার্ক, গচ্চা ১১৩৩ কোটি টাকা

SHARE

গল্পটা ডিজিটাল বাংলাদেশের। এই গল্পের অন্যতম রূপকার সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহেমদ পলক। তবে এই ডিজিটাল বাংলাদেশের অলীক গল্প শুনিয়ে অ্যানালগ বাংলাদেশে বাস করা ১৮ কোটি মানুষের সঙ্গে ডিজিটাল প্রতারণার খলনায়ক তিনি। অনিয়ম-দুর্নীতি, কমিশন বাণিজ্য, বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে লুটপাটের মাধ্যমে তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন হাজার কোটি টাকা।

একসময়ের ধারদেনা করে চলা পলকের সম্পদ এখন শুধু দেশেই নয়, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও দুবাইয়েও তার বিপুল সম্পদ এবং কয়েক হাজার কোটি টাকা পাচারের তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
পলকের প্রতারণার রহস্য ভেদ করতে একযোগে মাঠে নেমেছে সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা—বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (সিআইসি), পুলিশের সিআইডি। তবে পলকের প্রকল্পকেন্দ্রিক প্রতারণার জাল ভেদ করতেই হিমশিম খাচ্ছে তারা।

লাভজনক বিনিয়োগ দেখিয়ে ভারতের জটিল ঋণে জেলা পর্যায়ে আইটি বা হাই-টেক পার্ক নির্মাণে (১২ আইটি) ২০১৭ সালে এক হাজার ৭৯৬ কোটি টাকা ব্যয়ে হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষকে দিয়ে প্রকল্প নেওয়ান পলক।
শুরুতে প্রকল্পে পণ্য আমদানিতে ভ্যাটের হিসাব না ধরে ইচ্ছা করেই প্রকল্প ব্যয় কম দেখিয়ে ধোঁকাবাজি করে অনুমোদন নেন পলক। তবে তিন বছরের প্রকল্পটি সাত বছরেও শেষ হয়নি। এখন তিন বছরের প্রকল্প গড়াচ্ছে ১০ বছরে। শুধু ভ্যাট বাবদই গচ্চা দিতে হচ্ছে এক হাজার ১৩৩ কোটি টাকা।
অন্তর্বর্তী সরকার এই প্রকল্পে বাকি অর্থ বিনিয়োগ নিয়েও শঙ্কায় রয়েছে। তাই যেসব কাজের এখনো টেন্ডার হয়নি বা টেন্ডার হলেও কাজ প্রাথমিক পর্যায়ে আছে, সেগুলো বাদ দিয়েছে। যেগুলোর ৩০ থেকে ৪০ শতাংশের বেশি কাজ হয়ে গেছে, সেগুলোই শেষ করার নির্দেশনা দিয়েছে।

ইআরডির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, হাসিনা সরকারের পতনের পর অপ্রয়োজনীয় পলকের এলাকার সিনেপ্লেক্সসহ পাঁচটি সিনেপ্লেক্স, পাঁচটি নলেজ পার্ক ও তিনটি ডরমিটরি ভবন নির্মাণ বাদ দেওয়া হচ্ছে। কাজ শুরু না হলে বাকিগুলোও বাদ যেত বলে মনে করছেন তারা।

পরিকল্পনা কমিশনে ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, এই ধরনের প্রকল্পগুলোর কোনো সফলতা নেই। যশোরে সাত বছর আগে আইটি পার্ক চালু হলেও উদ্দেশ্য সফল হয়নি। এক ধরনের মোবাইল বা কম্পিউটার মার্কেট, বুটিক সেন্টার বা রিসোর্ট হয়ে গেছে। যারা বিনিয়োগ করেছিলেন তারা হতাশ। অনেকেই প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছেন। একই অবস্থা অন্য আইটি পার্কগুলোরও।

সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্পটির মূল্যায়ন কমিটির সভা (পিইসি) অনুষ্ঠিত হয়। সভায় নতুন করে প্রকল্পটির আওতায় কোনো টেন্ডার না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। যে কাজগুলো চলমান, সেগুলোই শেষ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। যেসব জায়গায় একেবারে কম কাজ হয়েছে, সেগুলোও বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

এর আগে প্রকল্পটির পিইসির প্রস্তাবনায় টেন্ডার না হওয়া তিনটি সিনেপ্লেক্সের নির্মাণ ব্যয় বাড়িয়ে প্রকল্পটির ব্যয় আরো দুই হাজার ৩৫১ কোটি টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়, যাতে প্রকল্পের মোট ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় চার হাজার ১৯৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা। সেই প্রস্তাবিত বাড়তি ব্যয়ের মধ্যে সরকারি তহবিলের এক হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা এবং ভারতীয় ঋণের ৬০৫ কোটি টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়। মেয়াদ তিন বছর বাড়িয়ে ২০২৭ সালের জুন পর্যন্ত সময় চাওয়া হয়।

তবে এখন পিইসি সভার সিদ্ধান্তের আলোকে চলমান কাজের পণ্য আমদানি করতে ভ্যাট বাবদ যত টাকা লাগবে, সেটা বাড়িয়ে সংশোধন প্রস্তাব দিতে বলা হয়। এখন প্রকল্পটির ব্যয় বেড়ে দাঁড়াচ্ছে দুই হাজার ৯৯১ কোটি টাকা, যার মধ্যে ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিটের ঋণ এক হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা এবং সরকারি তহবিলের এক হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। নতুন করে প্রকল্পটির ব্যয় বাড়ানো হচ্ছে এক হাজার ১৪৫ কোটি টাকা।

আইসিটি মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রীর বিশ্বস্ত লোকজন বিভিন্ন প্রকল্পে দায়িত্ব নিয়ে লুটপাট করত। প্রয়োজন না থাকলেও পলককে খুশি করতে হাই-টেক পার্ক প্রকল্পেও তাঁর এলাকায় আইটি পার্ক ও সিনেপ্লেক্স ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, যে কারণে সেখানে জমিই পাওয়া যায়নি।

জানা গেছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন পলক। এই পরিচয়কে পুঁজি করে প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে শুরু করে দেশের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে আধিপত্য বিস্তার করেননি তিনি। আইসিটি খাতে যেকোনো প্রকল্প নিলেই ১৫ শতাংশ কমিশন দিতে হতো তাকে।

প্রকল্পটিতে ফের এক হাজার ১৪৫ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ানোর বিষয়ে প্রকল্পের পরিচালক এ কে এম ফজলুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, নতুন করে প্রকল্পটিতে এক হাজার ১৪৫ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ানো হচ্ছে, যার মধ্যে এক হাজার ১৩৩ কোটি টাকাই বাড়ছে ভ্যাটের জন্য। তিনি জানান, আগে প্রকল্পটিতে ভ্যাট বাবদ তেমন টাকা ধরা ছিল না। প্রকল্পটিতে ভারতীয় ঋণের শর্ত অনুযায়ী ৬৫ শতাংশই ভারত থেকে আমদানি করতে হচ্ছে, যার জন্য এই ভ্যাট লাগবে।

পরিকল্পনা কমিশন ও ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, তেমন কাজ না হওয়ায় বাদ দেওয়া হচ্ছে কক্সবাজার, কুমিল্লা, সিলেট ও চট্টগ্রামের চারটি নলেজ পার্কের কাজ। এই চারটিতে ১ থেকে ৫ শতাংশ কাজ হয় বলে জানা গেছে। এদিকে প্রায় ১৫ শতাংশ কাজ হয়ে গেলেও সরকার পতনের পর বাদ দেওয়া হচ্ছে গোপালগঞ্জে নলেজ পার্কের কাজ; যদিও প্রকল্প কর্তৃপক্ষ বলছে, কলেজ কর্তৃপক্ষই চাচ্ছে না সেখানে নলেজ পার্ক হোক।

প্রকল্পের ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) ছয়টি জেলায় সিনেপ্লেক্স ভবন ও তিনটিতে ডরমিটরি ভবন নির্মাণের সংস্থান ছিল।

জানা গেছে, কাজ শুরু না হওয়ায় কেরানীগঞ্জের একটি বাদে পাঁচটি সিনেপ্লেক্স ভবন নির্মাণই বাদ যাচ্ছে। কেরানীগঞ্জ সিনেপ্লেক্সের কাজ ৬০ শতাংশ শেষ হয়েছে বলে জানা গেছে।

প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রকল্পটির প্রতিটি কাজে শর্ত অনুযায়ী ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকের অনুমতি নিতে হয়েছে। অনুমোদনের কাগজ পাঠানো হলেও তাদের জবাব অনেক পরে আসত। এতে সময় ও ব্যয় বেড়েছে।

এদিকে প্রকল্পটির কিছু কাজে অনিয়মও পেয়েছে পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। ঢাকার কেরানীগঞ্জের নলেজ পার্ক নির্মাণকাজে নানা ত্রুটি পেয়েছে আইএমইডির অধীন প্রকল্পটির নিবিড় পরিবীক্ষণে থাকা আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠান ইস্কার্ফ কনসাল্টিং ফার্ম। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, কেরানীগঞ্জের নলেজ পার্ক নির্মাণকাজের গাঁথুনির ক্ষেত্রে ব্যবহূত বালু মানসম্পন্ন নয়।

প্রকল্প পরিচালকের দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত জুন মাস পর্যন্ত প্রকল্পের আওতায় খরচ হয়েছে ৬২৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের ১২৯ কোটি ৩৩ লাখ এবং বৈদেশিক ঋণের ৪৯৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৩৩.৯২ এবং বাস্তব অগ্রগতি ৩৬ শতাংশ। জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ায় এরপর আর অর্থ খরচ হয়নি। এখন পরিকল্পনা কমিশনের পরামর্শমতো প্রাথমিকভাবে প্রকল্পের শুধু এক বছর মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে।

এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই প্রকল্পগুলো ডিজিটাল বাংলাদেশের নামে লুটপাটের সুযোগ সৃষ্টি করার জন্য করা হয়েছে। সেটা করা হয়েছে সম্পূর্ণ ক্ষমতার অপব্যবহার করে, যেহেতু কোনো ধরনের জবাবদিহির সুযোগ ছিল না। জবাবদিহির সব রাস্তা বন্ধ করে লুটপাটের মহোৎসব করা হয়েছে। এখন এই ক্ষতির পরিমাণ কিভাবে কমানো যায়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে।’