দুই বোন, এক অন্ধকার ঘর, আর এক টুকরো স্বপ্ন—এই নিয়েই এগিয়ে যায় অ্যাডাম জে গ্রেভসের আবেগপ্রবণ শর্টফিল্ম অনুজা। মাত্র ২২ মিনিটের এই সিনেমা আমাদের সামনে তুলে ধরে এক অনবদ্য গল্প, যেখানে টিকে থাকার সংগ্রাম আর একে অপরের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দারুণভাবে ফুটে উঠেছে।
দুই বোন, এক সম্পর্ক
ছোট বোন অনুজার বয়স মাত্র ৯, আর বড় বোন পলকের ১৭। জীবনের কঠিন বাস্তবতা তাদের স্কুলের গণ্ডি পেরোতে দেয়নি, তাই দুজনই পোশাক কারখানায় কাজ করে।
তবে এর মাঝেও এক টুকরো আশার আলো খুঁজে পায় তারা। পলক চায় অনুজাকে পড়াশোনা করাতে, কিন্তু স্কুলের পরীক্ষার ফি জোগাড় করা তাদের জন্য এক অসম্ভব ব্যাপার। এভাবেই শুরু হয় তাদের এক অনন্য উদ্যোগ—কারখানার অতিরিক্ত কাপড় দিয়ে ব্যাগ বানিয়ে বিক্রি করার চেষ্টা।
সংগ্রাম ও স্বপ্নের দ্বন্দ্ব
তাদের ব্যাগ কেউ কিনতে চায় না, কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে এক সুপারশপে গিয়ে অনুজা ৮০০ টাকা পেয়ে যায়।
সেই টাকা দিয়ে আনন্দে দুজন সিনেমা দেখে, জিলাপি খায়। কিন্তু পরদিনই কঠিন বাস্তবতা ধাক্কা দেয়। অনুজার গণিতের দক্ষতা দেখে কারখানার ম্যানেজার তাকে অফিসে কাজ করার প্রস্তাব দেয়—যদি সে রাজি না হয়, তাহলে বোনসহ দুজনকেই চাকরি হারাতে হবে।
এটাই গল্পের মোড় ঘোরানোর মুহূর্ত।
অনুজা কি পরীক্ষায় বসবে, নাকি পরিবারের ভবিষ্যৎ রক্ষা করতে পলকের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যাবে?
গভীরতম অনুভূতির প্রশ্ন
সিনেমার সবচেয়ে হৃদয়ছোঁয়া মুহূর্তটি আসে যখন অনুজা বোর্ডিং স্কুল সম্পর্কে জানতে চায়। পলক যখন বোর্ডিং স্কুলকে “বুদ্ধিমতী মেয়েদের জায়গা” বলে ব্যাখ্যা করে, তখন অনুজার প্রতিক্রিয়া হৃদয় ভেঙে দেওয়ার মতো—”আমি যদি বুদ্ধিমতী মেয়ে না হতে চাই, তাহলে কী হবে?”
এই সংলাপ আমাদের সমাজব্যবস্থার এক কঠিন বাস্তবতা তুলে ধরে, যেখানে শিক্ষা সবসময় মেধার সঙ্গে যুক্ত করা হয়, অথচ অনেক সময় কেবল সুযোগের অভাবে মেধাবী শিশুরাও পিছিয়ে পড়ে।
অভিনয় ও নির্মাণশৈলী
সাজদা পাঠান (অনুজা) ও অনন্যা শানভাগ (পলক) তাদের চরিত্রে এতটাই স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয় করেছেন যে দর্শক এক মুহূর্তের জন্যও তাদের রক্ত-মাংসের মানুষ বলে মনে না করে পারে না। দুই বোনের সম্পর্কের আন্তরিকতা, ছোট ছোট হাসি-কান্না আর বাস্তব জীবনের টানাপোড়েন দর্শকদের হৃদয়ে গেঁথে যাবে।
অ্যাডাম জে গ্রেভসের পরিচালনা অনবদ্য।
ক্যামেরার কাজ থেকে শুরু করে আলো-ছায়ার ব্যালান্স, প্রতিটি দৃশ্যে এক ধরনের স্নিগ্ধতা আর বাস্তবতার মিশেল দেখা যায়।
একাডেমি পুরস্কারে স্বীকৃতি
৯৭তম একাডেমি পুরস্কারে সেরা লাইভ অ্যাকশন শর্টফিল্ম বিভাগে মনোনীত হওয়া এই সিনেমাটি শুধু একটি গল্প নয়, বরং হাজারো অনুজাদের বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি। সমাজের কঠোর বাস্তবতা, অর্থনৈতিক দুরবস্থা, এবং শিক্ষার অনিশ্চয়তার মাঝেও বোনের প্রতি অটুট ভালোবাসা সিনেমাটিকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
শেষকথা
অনুজা কেবল একটি শর্টফিল্ম নয়, এটি বাস্তবতার দর্পণ। জীবনের অন্ধকার গলির ভিতরেও আশার আলো থাকে, ত্যাগ ও ভালোবাসাই সেটিকে উজ্জ্বল করে তোলে। সিনেমাটি দেখার পর দর্শকের হৃদয়ে কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়—সংগ্রাম আর স্বপ্নের মধ্যে কোনটি বেছে নেওয়া উচিত? আমরা কি সত্যিই সমাজের সব অনুজাদের জন্য ন্যায্য সুযোগ তৈরি করতে পেরেছি?
যারা হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া গল্প পছন্দ করেন, তাদের জন্য অনুজা নিঃসন্দেহে এক আবশ্যক দর্শনীয় চলচ্চিত্র।