বিশ্বজুড়ে দরিদ্র মানুষের অবস্থার উন্নতি না ঘটলেও ধনীর সম্পদ আগের চেয়ে অনেক দ্রুত বাড়ছে। শুধু ২০২৪ সালেই বিলিয়নেয়ারদের সম্পদ বেড়েছে দুই ট্রিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ দিনে তাদের সম্পদ বেড়েছে ৫৭০ কোটি ডলার করে। সম্পদের এই বৃদ্ধি আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে তিন গুণ দ্রুতগতিতে হয়েছে।
গড়ে প্রতি সপ্তাহে বিশ্বে চারজন বিলিয়নেয়ার তৈরি হয়েছে। অথচ বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ১৯৯০ সালের পর থেকে বিশ্বে এখনো দরিদ্র মানুষের সংখ্যা অপরিবার্তিত রয়েছে।
সোমবার (২০ জানুয়ারি) যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা অক্সফাম প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে।
প্রতিবেদেন বলা হয়, ২০২৪ সালে বিশ্বে বিলিয়নেয়ারের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে দুই হাজার ৭৬৯ জন।
২০২৩ সালে ছিল দুই হাজার ৫৬৫ জন। ১২ মাসে তাদের সম্মিলিত সম্পদ ১৩ ট্রিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে হয়েছে ১৫ ট্রিলিয়ন ডলার। রেকর্ড শুরু করার পর থেকে এটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বার্ষিক বৃদ্ধি।
এসব মাত্রাতিরিক্ত ধনীরা কোথা থেকে এত সম্পদ পেয়েছেন বা পাচ্ছেন, তার ব্যাখ্যা দিয়েছে অক্সফাম।
এসব ধনী, বিশেষ করে ইউরোপের ধনীদের একটি বড় অংশ পরিবার থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে এসব সম্পদ পেয়েছেন এবং তাদের সে সম্পদের একটি অংশ এসেছে ঔপনিবেশিক আমলে। যেমন—ফ্রান্সের ‘মিডিয়া মোগল’ ভিনসেন্ট বোলোরের সম্পদ। তার সম্পদের বড় একটি অংশ এসেছে ঔপনিবেশিক আমলে আফ্রিকায় তার নানা কম্পানির আয় থেকে।
আজও এভাবে সম্পদের শোষণ চলছে বলে জানিয়েছে অক্সফাম। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই শোষণের মাধ্যমে পৃথিবীর দক্ষিণাঞ্চলের দেশগুলো থেকে বিশাল অঙ্কের অর্থ এখনো পৃথিবীর পশ্চিম ও উত্তরের দেশ এবং ওই সব দেশের নাগরিকদের হাতে চলে যাচ্ছে।
অক্সফাম একে আধুনিক সময়ের ‘উপনিবেশবাদ’ বলে বর্ণনা করেছে। আধুনিক উপনিবেশবাদে এ শোষণ চলে নিয়ন্ত্রিত আর্থিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে।
অক্সফামের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালে এই আর্থিক ব্যবস্থার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের মতো উত্তরের দেশগুলোর ১ শতাংশ ধনী দক্ষিণের দেশগুলো থেকে প্রতি ঘণ্টায় তিন কোটি মার্কিন ডলার নিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের মোট সম্পদের ৬৯ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ এই উত্তরের দেশগুলোর হাতে। শতকোটিপতিদের মোট সম্পদের ৭৭ শতাংশ এসব দেশে। ৬৮ শতাংশ শতকোটিপতি উত্তরের দেশগুলোতে বসবাস করেন। অথচ বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র ২১ শতাংশ ওই সব দেশে বসবাস করে।
অক্সফাম তাদের ‘টেকার্স নট মেকার্স’ শিরোনামে এই প্রতিবেদনে ঔপনিবেশিক আমলে ধনী দেশগুলো কিভাবে তাদের উপনিবেশ থেকে সম্পদ শোষণ করেছে তার উদাহরণও দিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্যের ১০ শতাংশ ধনকুবের ঔপনিবেশিক আমলে তাদের সম্পদের অর্ধেক পেয়েছেন ভারত থেকে। এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে ভারত ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল। সেই সময়ে ব্রিটিশরা ৬৪ লাখ ৮২ হাজার কোটি ডলার মূল্যের সম্পদ ভারত থেকে নিজেদের দেশে নিয়ে যায়। ওই সম্পদের মধ্যে ৩৩ লাখ আট হাজার কোটি ডলার অর্থ গেছে যুক্তরাজ্যের ওই ১০ শতাংশ ধনীর হাতে। এই অর্থ যদি ৫০ পাউন্ডে ভাঙানো হয়, তবে সেই নোট দিয়ে পুরো লন্ডন প্রায় চারবার ঢেকে ফেলা যাবে।
অক্সফাম হিসাব করে দেখেছে, শুধু যুক্তরাজ্য নয়, পুরো বিশ্বে ধনকুবেরদের ৩৬ শতাংশ সম্পদ এসেছে উত্তরাধিকারসূত্রে। ফোর্বসের এক গবেষণা অনুযায়ী, ৩০ বছর বয়সের নিচে যত শতকোটিপতি আছেন, তাঁদের সবাই উত্তরাধিকারসূত্রে সম্পদের মালিক হয়েছেন।
বিনিয়োগ খাতের আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ইউবিএসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আজকের এক হাজারের বেশি শতকোটিপতির পাঁচ লাখ ২০ হাজার কোটি ডলারের বেশি সম্পদ আগামী দুই থেকে তিন দশকের মধ্যে তাদের উত্তরাধিকারের হাতে চলে যাবে।
পৃথিবী শতকোটিপতি দেখলেও এখনো লাখ কোটিপতি পায়নি। তবে সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যখন একজন মানুষের সম্পদ বেড়ে লাখ কোটিপতির ঘর ছুঁয়ে ফেলবে। অক্সফামের প্রতিবেদনে সে পূর্বাভাসই দেওয়া হয়েছে।
অক্সফামের পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী এক দশকে বিশ্ব অন্তত পাঁচজন লাখ কোটিপতিকে দেখতে পাবে। ২০২৩ সালে সংস্থাটি আগামী এক দশকে একজন লাখ কোটিপতি দেখতে পাওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছিল। কিভাবে ধনকুবেরদের এই সম্পদের পাহাড় গড়া আটকে ধনী-গরিবের মধ্যে বৈষম্য কমিয়ে আনা যায়, সেই পরামর্শও দিয়েছে অক্সফাম।
অক্সফামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ জন্য বিভিন্ন দেশের সরকারকে নিজ নিজ দেশ এবং বৈশ্বিকভাবে ধনী ও গরিবের মধ্যে আয়ের ব্যবধান কমাতে হবে। এ জন্য এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যেন সমাজের ওপরতলার ১০ শতাংশ মানুষের আয় সমাজের নিচের তলার ৪০ শতাংশ মানুষের আয়কে ছাড়িয়ে যেতে না পারে। আয়ের বৈষম্য দূর করা সম্ভব হলে তিন গুণ বেশি গতিতে দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব হবে বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক।
এ ছাড়া ধনীদের কাছ থেকে আরো কর আদায় করে তাদের অতিরিক্ত ধনী হওয়া আটকানো যেতে পারে। সেই সঙ্গে কর দিতে হয় না, এমন স্থান এবং ব্যবস্থা বিলুপ্ত করতে হবে। অক্সফামের বিশ্লেষকরা দেখেছেন, শতকোটিপতিদের অর্ধেক এমন দেশে বসবাস করেন, যেখানে সরাসরি উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সম্পদের জন্য কর দিতে হয় না।